পাশের দোকানের কর্মচারীকে বিশ্বাস করাই কাল হলো স্বর্ণ ব্যবসায়ী স্বপন চৌধুরীর। প্রতিদিন দোকানের তালা খুলে দেওয়ার নামে মাথায় চাপে চুরির ভূত। অতঃপর বানিয়ে ফেলে নকল চাবি। দু’তিন দফায় চুরি করে সীমিত পরিসরে।
এক পর্যায়ে সদলবলে মোটা অঙ্কের স্বর্ণালংকার চুরি করে সমুদ্রস্নানে পাড়ি জমায় কক্সবাজার। অগত্যা পুলিশ আসে। মামলা হয়। ডিবি পুলিশের জালে ধরা পড়ে যায় পুরো চক্রের সদস্যরা।
সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর এমন চুরির ঘটনা ঘটে রাজধানীর চাঁদনী চক মার্কেটে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চোর চক্রের মূল হোতা ফরহাদ হোসেন ওরফে চুগি (২৫)। সে ছিল পাশের দোকান নেহা জুয়েলার্সের কর্মচারী। ঘটনার শিকার স্বপন চৌধুরীর দোকানের নাম সততা জুয়েলার্স। তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ। যে কারণে প্রতিদিন দোকান খোলা ও বন্ধ করার সময় ফরহাদের সহায়তা নিতেন।
এজন্য প্রতি মাসে তাকে দুই হাজার টাকা বকশিসও দিতেন। করতেন অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু সে বিশ্বাসের মর্যাদা ফরহাদ বেশি দিন ধরে রাখেননি। মাত্র কয়েক মাসের মাথায় স্বর্ণালংকার চুরির খারাপ চিন্তা ভর করে তার মাথায়। এরপর সে দোকানের মোট ১৪টি তালার মধ্যে পেছনের চারটি তালাকে টার্গেট করে। কিন্তু কিভাবে কী করা যায়, ভেবে পাচ্ছিল না। একসময় ভাবে চারটি তালার নকল বা ডুপ্লিকেট চাবি বানাবেন। এজন্য রাতে দোকান বন্ধ করার পর চাবির ছড়ি জমা দেওয়ার সময় সেখান থেকে একটি করে চাবি সরিয়ে রাখতেন। পরদিন তালা-চাবির মিস্ত্রির কাছে গিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নিতেন।
এভাবে চারটি তালার ডুপ্লিকেট চাবি বানাতে তিনি সফল হয়ে যান। এক রাতে দোকান বন্ধের পর ফের মার্কেটে ফিরে এসে ডুব্লিকেট চাবি দিয়ে চারটি তালা খুলে দোকানের ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। প্রথম দিন কিছুটা নার্ভাস থাকায় বেশি কিছু নিতে সাহস করেননি। ছোটখাটো ২/১টি স্বর্ণালংকার চুরি করেন। এভাবে আরও দু’দিন চুরি করেন।
তিন দিনে কিছু স্বর্ণাংলকার খোয়া যাওয়ায় দোকান মালিক দোকানে রক্ষিত স্বর্ণালংকারের হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। কয়েক দফা গণনা করার পর ভাবছিলেন হয়তো কোথাও তার নিজের ভুল হচ্ছে। কিন্তু তত দিনে চোরের সাহস আরও বেড়ে যায়। তিন দফার ছোট চুরিতে ধরা না পড়ায় এবার সে বড় চুরির ফন্দি করে। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে ১৫ লক্ষাধিক টাকার স্বর্ণালংকার নিয়ে সটকে পড়ে। এবারও হয়তো ভেবেছিল অতি বিশ্বাসী মালিক তাকে সন্দেহ করবেন না। তার কিছুই হবে না।
তাই চুরি করা স্বর্ণ বিক্রির টাকায় বহু দিনের সাধ মেটাতে সদলবলে চলে যান কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। তিন দিন কক্সবাজারে সমুদ্রবিলাসে আনন্দ স্ফুর্তি শেষে ফিরে আসে ঢাকায়। কিন্তু বিধি বাম। ততক্ষণে ডিবি পুলিশের নজদারি আর প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানের জালে তাদের গ্রেফতার করার সময় ঘনিয়ে আসে। যাবতীয় তথ্য প্রমাণ পাবার পর ডিবি পুলিশ প্রথমে গ্রেফতার করে মূল হোতা ফরহাদকে।
এরপর তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে একে একে আরও ১০ সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে চাঞ্চল্যকর চুরির বিস্তারিত ঘটনা বেরিয়ে আসে। এ ঘটনা স্বপন চৌধুরী ছাড়াও চাঁদনী চক মার্কেটের অন্য ব্যবসায়ীদের ভাবিয়ে তুলেছে। অনেকে এ ঘটনা থেকে নতুন করে শিক্ষা নিতে চান।
জানতে চাইলে সততা জুয়েলার্সের মালিক ভুক্তভোগী স্বপন চৌধুরী জানান, ‘পাশের দোকানের কর্মচারী ফরহাদকে আমি অনেক বিশ্বাস করতাম। এই বিশ্বাসই আমার জন্য কাল হয়েছে। সে যে আমার দোকানে চুরি করতে পারে, তা আমার কখনো সন্দেহে আসেনি। অথচ এমন জঘন্য কাজ সে করেছে।’
ডিবির রমনা বিভাগের ডিসি মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, গ্রেফতাররা প্রাথমিকভাবে চুরির দায় স্বীকার করেছে। দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আরও তথ্যের জন্য আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারা জানিয়েছে, চুরির ঘটনার পর ৯০ হাজার টাকা খরচ করে চক্রের সদস্যরা তিন রাত কক্সবাজার অবস্থান করে। টাকা শেষ হওয়ায় আবারও ঢাকায় স্বর্ণালংকার বিক্রি করতে এলে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
ডিবির রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনাল এডিসি মোহাম্মদ ফজলে এলাহী জানান, গ্রেফতার ১১ জনের মধ্যে আরিফ ও ওবায়েদ চোরাই স্বর্ণের ক্রেতা। তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
সূত্র জানায়, গ্রেফতার সবাইকে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালত চোর চক্রের মূল হোতা ফরহাদ হোসেন ওরফে চুগিসহ তিনজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাকিদের রিমান্ড প্রক্রিয়াধীন।
ডিবি পুলিশ জানায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায় চাঁদনী চক মার্কেটের ৩ নম্বর ভবনে অবস্থিত সততা জুয়েলার্স থেকে অন্তত ২০ ভরি চুরির ঘটনা ঘটে। মার্কেটের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ডিবি কর্মকর্তারা জানতে পারেন, ১৯ সেপ্টেম্বর তালা খুলে সততা জুয়েলার্সে চুরির ঘটনা ঘটিয়ে চারজন লোক ব্যাগ হাতে মার্কেট থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। চোর চক্রের সদস্যরা চুরি করা স্বর্ণালংকার তাঁতীবাজার ও আজিমপুরের বিভিন্ন স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করে।
চুরি করা স্বর্ণ বিক্রির টাকায় ওই চারজনসহ ছয় বন্ধু নিউমার্কেট থেকে একই ধরনের প্যান্ট ও শার্ট কেনে। এরপর বেড়াতে যায় কক্সবাজার।
চাঞ্চল্যকর এ চুরির ঘটনায় ফরহাদ হোসেন ওরফে চুগি ছাড়াও গ্রেফতাররা হলেন মো. মারুফ, মো. জাহিদ, মো. সাকিব, মো. আব্দুল্লাহ স্বপন, মো. আরিফ, মো. তারা মিয়া, মো. শুকুর মিয়া, মো. ফজলু মাতাব্বর, তপন রায় ও মো. ওবায়েদ হোসেন। রাজধানীর লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় গত মঙ্গল ও বুধবার ধারাবাহিক অভিযানে চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে চুরি করা চারটি স্বর্ণের চুড়ি, তিনটি স্বর্ণের আংটি ও এক জোড়া কানের দুল উদ্ধার করা হয়।
পাঠকের মতামত